বিলুপ্ত ছিটমহলের ইতিকথা

Homeসাহিত্য ও ফিচার

বিলুপ্ত ছিটমহলের ইতিকথা

১৯৪৭ খ্রীস্টাব্দে অখন্ড ভারতকে বিভক্তের সময় ৩জুন বিট্রিশ আইনজীবি সিরিল র্যাডক্লিফকে চেয়ারম্যান নিযুক্ত করে একটি সীমান্ত কমিশন গঠন করা হয়।পরে ১৬আগষ্ট সীমানা নির্ধারণের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করা হয় ভারত ও পাকিস্তানের চুড়ান্ত মানচিত্র। বৃটিশ শাসকদের ডিভাইস এন্ড রুলস নীতির স্বার্থক প্রয়োগ করে র্যাডক্লিফ কমিশন ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত এলাকাগুলোকে ছোট ছোট জনপদে এমনভাবে ভাগাভাগি করেছিল যাতে প্রতিবেশী দুদেশের মধ্যে সীমান্ত বিরোধ বিরাজ করে।আর এর জন্যই প্রতিষ্ঠিত হয় ছিটমহল(ঊহপষধাব)নামক জনপদটির। এসব ছিটমহলের মধ্যে তৎকালীন পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ছিল ভারতের ১১১টি যার জমির পমিাণ ১৭১৬০.৬৩একর।আর ভারতের অভ্যন্তরে ছিল পাকিস্তানের ৫১টি ছিটমহল।যার জমির পরিমাণ ৭১১৯.০২একর।এদিকে বৃটিশ কর্তৃক বিভাজন করা ছিটমহল সমস্যা নিরসনে ১৯৫৮ সালের ১০ সেপ্টেম্বর ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ফিরোজ খান নুনের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যা নেহেরু-নুন চুক্তি নামে পরিচিত।চুক্তিতে ছিটমহলগুলোকে পরিবেষ্টিত এলাকা হিসেবে উল্লেখ করা হয়।এর মধ্যে সর্ববৃহৎ ছিটমহল ছিল দহগ্রাম-আঙ্গোরপোতা।যেটি সারাদেশে ব্যাপকভাবে পরিচিত।এ ছিটমহলের সাথে তৎকালীন পাকিস্তানের মূল ভূখন্ডে যোগাযোগের জন্য একটি প্যাসেজ ডোর এর ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল।যা বর্তমানে “তিনবিঘা কড়িডোর” নামে পরিচিত।
১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন হয়।সেসময়ে বাংলাদেশের মধ্যে থেকে যায় ভারতের ১১১টি ছিটমহল আর ভারতে থেকে যায় বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল। পরে বাংলাদেশ আমলে ১৯৭৪ সালের ১৬ মে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধির মধ্যে স্থল সীমান্ত চুক্তি হয়।যা ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি নামে পরিচিত।এদিকে দীর্ঘ সময়ে চুক্তি কার্যকর না হওয়ায় ১৯৯২ সালে বিএনপি সরকারের সময়ে ২৬ জুন ইজারা চুক্তির মাধ্যমে ভারত নিয়ন্ত্রিত তিন বিঘা নামক জায়গাটিতে নির্মিত কড়িডোর ফটক দিয়ে দিনের বেলা ১ঘন্টা পর পর বাংলাদেশের মূল ভূখন্ডের পাটগ্রাম উপজেলায় যাতায়াত শুরু হয় দহগ্রাম-আঙ্গোরপোতাবাসীর।এসময় সারাদিন চলাচলের দাবীতে ছিটমহলবাসী দাবী তুললে ২০০১ সালের ২৭এপ্রিল হতে সকাল সাড়ে ৬ টা থেকে সন্ধা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত কড়িডোর ফটক খোলা রাখা হয়। পরে বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকারের আমলেই ২০১১সালের ৮আগষ্ট থেকে তিনবিঘা কড়িডোর ফটকটি ২৪ঘন্টাই খোলা রাখা শুরু হয়।
এদিকে ১৯৯৩ সালে ভারতের দিনহাটার সাবেক বিধায়ক প্রয়াত দীপক সেনগুপ্ত প্রতিষ্ঠা করেন “ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটি।” উভয় দেশে অবস্থিত ১৬২টি ছিটমহল বাসীকে স্বাধীনভাবে চলাচলের সুযোগ প্রদান,নাগরিক অধিকারের দাবীতে ছিটমহল বিনিময় শ্লোগান তুলে আন্দোলন গড়ে তোলেন উভয় দেশের ছিটমহলবাসীরা।আন্দোলনে যোগ দেয় মূল ভূখন্ডের শিক্ষার্থী,সুশীল সমাজ,রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিকগন।
আন্দোলনের ফসল হিসেবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১১ সালের ৬সেপ্টেম্বর তারিখে ১৯৭৪ এ প্রণীত স্থলসীমান্ত চুক্তির প্রটোকলে স্বাক্ষর করেন।পরে উভয় রাষ্ট্র প্রধানের ঐকান্তিক চেষ্টায় চুক্তিটি ২০১৫ সালের ৫মে ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভায় অনুমোদিত হয়।এবং ৬ মে রাজ্যসভায় আর ৭ মে লোকসভায় পাশ হয়।অবসান ঘটে ৪১বছরের বঞ্চনার।সাথে সাথে সমাধান হয় দীর্ঘ ৬৮বছর ধরে ঝুলে থাকা ছিটমহল সমস্যার।অবশেষে চুক্তির দলিল হস্তান্তরের মধ্যে দিয়ে ২০১৫ সালের ৩১জুলাই মধ্যরাতে আনুষ্ঠানিকভাবে বিনিময় হয় উভয় দেশের ছিটমহলগুলো।আর ১আগষ্ট প্রতূষ্যে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মধ্যে ছিটমহল নামটি বিলুপ্ত হয়ে স্বাধীন দেশের নাগরিকের মর্যাদা লাভ করে উভয় দেশের ১৬২টি বিলুপ্ত ছিটমহলের অর্ধলক্ষাধিক মানুষ।ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পায় ছিটমহল নামটি।

লেখক:তৌহিদুল ইসলাম লিটন
সম্পাদক, ছিটমহল নিউজ
thouhid00@gmail.com

COMMENTS

WORDPRESS: 0
DISQUS: 0